এক
শীতের পড়ন্ত বিকেল, কুয়াশা তখনো ঘন হয়ে উঠেনি। মায়ের নির্দেশে খুদেজা কলসি নিয়ে পুকুরে দিকে গেলেন। বাড়ির পেছনেই পুকুর। নিথর নিস্তব্ধ পুকুরঘাট। আজ খানিকটা সেজেছে খুদেজা। তার আয়ত নয়নে কাজল লাগিয়েছে যারা জীবনানন্দ দাসকে জানেন কিংবা শুনেছেন বনলতা সেনের দু-চার লাইন তারা খুদেজার চোখের দিকে তাকিয়ে মনের অজান্তেই আবৃত্তি করবেন "চোখ তার কবেকার বিদিশার অন্ধকার দিশা" মেঘকালো চুলে তুলেছে বেণী। এই সামান্য সাজেও তাকে অপূর্ব লাগছে। গাঁয়ের সুন্দরী মেয়েদের মধ্যে সে অনন্য, যেমন লম্বা শরীর তেমনি সুন্দর মুখ, তাকে এক কবি নাকি বলেছিলো সে বনলতা নয় স্নিগ্ধ লতা, লতা তো সে জানে কিন্তু স্নিগ্ধ কি জেনে খুব হেঁসেছিলো খুদেজা। এখনো মাঝে মধ্যে সে কথা মনে হলে মনে মনে হাসে খুদেজা।
খুদেজা পুকুরে যতদূর পানিতে নামলে পায়ের আলতা মাখা পা'টুকু ডুবে সে আলতা পানিতে নেমে আজই প্রথম আবিষ্কার করলো বালুকণাগুলো তার পায়ের উপর খেলা করছে। নখের উপর, আঙ্গুলের ফাঁকে, পা নড়লেই নড়ে উঠে বালুকণা। ধীরে ধীরে পা নেড়ে নেড়ে খেলা দেখছে খুদেজা। হঠাৎ পানির ওপর ডিল ছুড়ে মারার আওয়াজ শুনলো, খানিকটা জলের ছটা এসে পড়লো খুদেজার শরীরেও। থতমত খেয়ে খুদেজা উপরে তাকায়। হাশেম দাঁড়িয়ে মৃদু হাসছে।
খুদেজা দ্রুত কলসি ভরা পানি নিয়ে হাশেমের বরাবর এসে একটি মৃদু হাসি দিয়ে পাশ কেটে বাড়ি চলে যায়। হাশেম খুব সুখ অনুভব করে। মনের ওপর জমে থাকা বোঝাটা আজ বুঝি নেমে গেলো। তাকে যে খুদেজা ভালবাসে তার ইঙ্গিত সে মিষ্টি সুন্দর হাসি। যে হাসি বুকে ধরে বাঁচা যায় অনন্তকাল। অনেক দিন খুদেজার পিছু ঘুরছিলো হাশেম। কিন্তু কখনো পাত্তা দিতো না। বহুবার ভালবাসার কথা বলেছে কখনো শুনতো বলে মনে হতো না। কিন্তু আজ তার আবীর ছাড়ানো সুন্দর হাসি যেন পাগল করে দিলো। স্বপ্ন দেখার গতি যেন একশোগুণ বেড়ে গেলো।
দুই
হাশেম অল্পদিনেই অনেক দূর এগিয়ে যায়, খুদেজার সাথে ভাবের পূর্ণাঙ্গ আদান প্রদান ঘটিয়ে, কাশবন, বন,পাখি, নদী, আকাশ, মেঘ, ফুল, জল সবাইকে ভালবাসার কথা জানিয়ে দেয় ওরা দ'জন। হাশেম গিয়ে ঘটক ননি মিয়ার সহায়তা নেয়। ঘটক হাশেম কে বুঝানোর চেষ্টা করে।
-তুমি একজন সামর্থবান পোলা তুমি ক্যান এই বোবা মাইয়াডারে বিয়া করবা?
হাশেম অবশ্য ননী মিয়াকে প্রবোধ দেয়
-আমার বাবা-মা নাই। খুদেজারে বিয়া করলে মা-বাপ দুজনরেই পামু।
-তুমি যেহানেই বিয়া কর, মা-বাপ পাইবা, কিন্তুক এর ল্যাইগা কথা কইতে পারেনা এমুন একটা বোবা মাইয়ারে বিয়া করবা?
-যার এমন সুন্দর চোখ তার আবার কথা কওন লাগবো কিয়ের ল্যাইগা। এইডাছাড়া আমি হের সব কতা বুঝি, হে কথা কইতে পারে, কিন্তুক হগলে বুঝেনা। আমি বুঝি আমার অসুবিধা অইবো না। হেয়ও বালা কইরাই আমারে বুঝে। আমরার চলতে কোন অসুবিধা অইবো না।
-হুম বুঝছি, আর কওন লাগবো না। অবশ্য আরেকটা সুবিধা আছে, এক বাপের এক মাইয়া জমি জিরাত যা আছে সব তো মাইয়ারেই দিয়া যাইবো।
-না না আমি জমি-জমা চাইনা, আমি শুধু খুদেজারে চাই, মা-বাপ হারা এতিম, হেরারে মন ভইরা মা বাপ ডাকতে চাই।
-যাক পরেরটা পরে। আগে তো বিয়া। দেহি কি করন যায়। তুমি চিন্তা কইরো না।
হাশেম অবশ্য আগে খুদেজার বাপের সহায় সম্পত্তি নিয়া চিন্তা করে নাই। তাদের সব কিছু তো একদিন খুদেজারই হবে। খুদেজার মানেই তো হাশেমের।
তবে হাশেম একটি কথা বলে নিজে খুব পুলক অনুভব করছে। এমন সুন্দর চোখ যার তার কথা কওয়ার কি দরকার? ঠিকইতো চমৎকার টানা টানা সুন্দর দুটি চোখ, সে চোখের দিকে তাকিয়ে জীবন পার করে দেয়া যাবে অনায়াসে। এতো সুন্দর চোখ থাকতে কথা বলার কি দরকার?
তিন
খুদেজার বাবা-মা খুব সহজেই বিয়েতে রাজি হয়ে যান। কারণ হাশেম এমনিতে খুব ভালো ছেলে। সংসারে কোন ঝুট ঝামেলা নেই। তাতে করে খুদেজাকে সাধারণত: অন্য সংসারের মতো শ্বশুর-শাশুড়ির দেবর-ননদীর মন জয় চলতে হবে না। যেহেতু দু'জনের মধ্যে একটি বোঝাপড়া সৃষ্টি হয়েছে সেহেতু ভালোই থাকবে খুদেজা। তবে পারিবারিক বন্ধনহীন জীবন অনেকটা অনিরাপদ তাও বুঝতে পারেন খুদেজার বাবা-মা। কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে গেছে হাশেম আর খুদেজার ভালবাসা আর হাশেমের ভালো ব্যাবহার।
হাশেমের বাবা মারা যায় তার জন্মের এক বৎসরের মাথায়, তারপর থেকে মাকে অবলম্বন করে বড় হয় হাশেম ও তার বড় বোন শেফালী। হাশেমের চেয়ে শেফালী ১০ বৎসরের বড়। আর তাদের সম্পত্তি বলতে হাশেমের বাবার রেখে যাওয়া ভিটে খানি। মা ও শেফালী তাঁত মহাজনদের বাড়িতে ববিন, নলি ভরেই জীবিকা নির্বাহ করেন। কিন্ত যখন তাঁত ব্যবসায় ধস নামে তখন নানান রকমের কাজকর্ম করে জীবন চালাতে হয়েছে। পরে বড় বোন শেফালীর বিয়ে হয়ে গেলে তখন পুরোপুরি সংসারের দায়িত্ব কাঁধে নেন হাশেম। পরে একসময় মৃত্যু বরণ করেন হাশেমের মা, হাশেমের মা মারা যাওয়ার পর থেকেই হাশেমের বিয়ের কথাবার্তা চলতে থাকে। কিন্তু কখন যে খুদেজার প্রেমে পরে যান নিজেও বুঝতে পারেন না হাশেম। নিজের অজান্তেই ভালবেসে ফেলে খুদেজাকে। আর ভালবাসবেই না কেন? যেমন তার রূপ তেমনি তার শাররীক গড়ন। যেন সত্যি নাটোরের বনলতা সেন কিংবা ঐ মফস্বলের কবির কথায় স্নিগ্ধলতা ।
চার
গ্রামের একটি কৃষক পরিবারে যতোটা আনুষ্ঠানিক মানায় ততোটাই আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে সেরেছে খুদেজার বিবাহ পর্ব। কোথায়ও এতোটুকু ত্রুটি রাখেনি যাতে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারে। একমাত্র কন্যা খুদেজা, যথেষ্ট পরিমাণে গহনা ঘাটি দিয়ে সাজিয়ে, সঙ্গে প্রচুর মাল-সামান দিয়ে স্বামীর বাড়ি পাঠিয়েছে খুদেজাকে। যেন কোন কিছুর জন্য কারো কাছে হাত পাততে না হয়। খুদেজার মায়ের ইচ্ছে ছিল মেয়ে ও জামাইকে নিজের বাড়িতেই রেখে দেওয়া। তিন কুলে যার কেউ নেই। তাকে শ্বশুর বাড়িতে থাকলে সমস্যা কি? কিন্তু এখানে ঘোর আপত্তি জানায় খুদেজার বাবা। তার এককথা জামাই কে কেউ ঘরজামাই বলবে সেটা তার পছন্দ নয়। তাছাড়া এখনইতো কিছু করার সময়, পরে তার সঙ্গে শ্বশূর বাড়ির সম্পত্তি যোগ হলে তখন সে সম্পত্তির কদর করতে জানবে। আর এখনি পেয়ে গেলে বখেও যেতে পারে।
হাশেমের এই বোবা মেয়েকে বিয়ের উদ্দেশ্য অবশ্য গ্রামের অধিকাংশ মানুষই বাঁকা চোখে দেখছে। সবারই এক কথা সম্পত্তির লোভেই সে এই বিয়ে করেছে। সে কথা অবশ্য কানে নিতে নারাজ হাশেম। তার কথা ভালবেসেই বিয়ে করেছে খুদেজাকে। যে যাই বলুক বোবা মেয়েও ভালবাসতে জানে। সে কথার প্রমাণও দিচ্ছে খুদেজা। স্বামী মানে দেবতা, স্বামী মানে সুখের জীবন সঙ্গী। তাই স্বামী হাশেমের যত্নের কোন ত্রুটি করছেনা খুদেজা। তেমনি হাশেমও খুশি। ভালবাসার মানুষটিকে কাছে পেয়ে সে মানুষটির সুখ-দুঃখের খোঁজ খবর নিতে ভুল করে না সে। এক সঙ্গে খাবার খাওয়া, এক সঙ্গে বিশ্রামে যাওয়া, খুদেজার মাথা ব্যথা হলে কপাল টিপে দেওয়া থেকে সব ধরণের সহযোগিতাই করছে হাশেম।
খুদেজার মাও একই গ্রামে বিয়ে হওয়াতে মাঝে মধ্যে আসে মেয়ের খুঁজ খবর নিতে। মেয়ের মুখের খুশির হাসি দেখলে মায়ের মন জুড়িয়ে যায়। মন ভরে মেয়েকে দেখে হাশেমের জন্য বিধাতার কাছে সু-দোআ করতে করতে তৃপ্তি নিয়ে নিয়ে বাড়ি ফিরে। সেখানেও আপত্তি জানায় খুদেজার বাবা, তার মতে ঘন ঘন মেয়ের বাড়িতে যাওয়া শোভনীয় নয়। তাছাড়া বারবার মেয়েকে দেখতে গেলে আস্কারা পেয়ে পেয়ে মেয়ে স্বামীর সঙ্গে খারাপ ব্যাবহার করতে পারে। শেষে হিতে বিপরীত হতে পারে। এধরণের আশংকা প্রকাশ করেন খুদেজার বাবা বলেন মাইয়ার সুখইতো আমারার সুখ, হেয় সুখে আছে জানলে আমারা সুখে থাহুম, ঠিক না।
এদিকে হাশেম বিয়ের পর থেকে ঠিক মতো কাজে যেতে চায় না। বৌয়ের শাড়ির সুখ আঁচলে মুখ লোকিয়ে থাকতে চায়। প্রায়ই কাজে ফাঁকি দিয়ে বৌয়ের পিছ পিছ ঘুর ঘুর করে। খুদেজা রান্না ঘরে গেলে হাশেম রান্না ঘরে গিয়ে খুনসুটিতে মজে থাকে। সপ্তাহে দু-তিন দিন কাজে ফাঁকি দেওয়া একটি বাতিক হয়ে দাঁড়িয়ে। তাতে চলা ফেরা করতে অসুবিধা না হলেও সপ্তাহ শেষে হাতে কিছুই থাকছে না। তারপর যাই দু-চার টাকা থাকে তা দিয়ে স্ত্রীর জন্য কিছু আনতে ভুল করে না।
দুজনের ভালবাসা প্রগাঢ়তার খুঁজ পাওয়া যায় দু'জনের মধ্যকার মান-অভিমানের বহর দেখে। একজন একটু অভিমান করলেই অন্যজন মান ভাঙ্গাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। একজন চোখের আড়াল হলেই অন্যজন খুঁজতে বের হোন। সম্পূর্ণ একে অপরের পরিপূরক বলে ধরে নেয়া যায় আপাত দৃষ্টিতে।
পাঁচ
খুদেজার বাবার মনে চিন্তা ভর করে। কারণ হাশেম আস্তে আস্তে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছে তার কিছু খবরা খবর তিনি পাচ্ছে। তাতেই তিনি আতংকিত হয়ে পড়ছে। ঋণ করা কোন মানুষের জন্যই শোভনীয় নয়। ঋণ করলে মানুষ মানসিক ভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। ঋণগ্রস্ত মানুষের ঘরে শান্তি থাকেনা উপরন্তু সে সংসারের কর্তা ব্যক্তির চিন্তাশক্তি লোপ পায় এমনকি সংসারে যে কোন অঘটন ঘটে যেতে পারে। তাই কি করবে বুঝতে পারছেনা খুদেজার বাবা। হাশেমকে ডেকে কথা বলবে নাকি মেয়েটাকে বাড়ি এনে রাখবে কিছুদিন যাতে খুব সহজে হাশেম তার ঋণগুলো পরিশোধ করতে পারে। তাই কি ঠিক হবে? এমন সব ভাবনা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে খুদেজার বাবা।
ঋণে জর্জরিত হাশেম কোথাও কোন ভরসা পাচ্ছে না। প্রিয়তমা খুদেজার একটি হাসি দেখলে যে হাশেমের মনে হতো বিশ্বজয় করে ফেলেছে। আজ সে প্রিয়তমার হাসি মনে হয় জ্বলন্ত অগ্নিগিরি। ধীরে ধীরে কি করে এতো বড় ঋণের বোঝা মাথায় এসে পড়লো বুঝতেই পারেনি হাশেম। হতাশাগ্রস্ত জীবনে দিন দিন বেপরোয়া হয়ে যাচ্ছে হাশেম। অনেক রাতে বাসায় ফেরে। ঘরে ফিরে ঠিক মতো খায়না। ঘুমোতে গিয়েও আবার উঠে বসে থাকে। কাজেও যায়না ঠিকমতো। কাজ থেকে মন উঠে যাচ্ছে। ঋণের যন্ত্রণা কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে তাকে। তার বিশাল স্বপ্নের ভুবন চোখের সামনে আস্তে আস্তে ধসে পড়ছে। ঠেকাতে পারছে না, আটকাতে পারছেনা ভাটার টান, মন বসছে না ঘরে কিংবা কাজে। জীবনের উপর থেকে যেমনি উঠে যাচ্ছে মায়া, তেমনি শূন্যের কোঠায় নেমে আসছে ভালবাসার সূচক।
অভিমানী খুদেজা বুঝতে পারছে বিরাট একটি সমস্যা চলছে নতুন দাম্পত্য জীবনে। দুজনের সুখময় জীবনটি কেন এমন হয়ে গেল? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছে, কিন্তু পায়নি। হাশেমের আচরণ তাকে কষ্ট দিচ্ছে। খুদেজা অনেকবার চেষ্টা করেছে, অনেক কাকুতি-মিনতি করেছে সমস্যার উৎস টুকু জানার জন্য কিন্তু লাভ হয়নি। খুদেজার কাকুতি মিনতিতে হাশেম আরও বিরক্ত প্রকাশ করেছে। খুদেজার চোখের জল স্পর্শ করছেনা হাশেমকে। হাশেম তার ঋণের ভাবনার কাছে সব কিছুই ম্লান। 'অভাব যখন দরজায় এসে দাঁড়ায় ভালবাসা তখন জানালা দিয়ে পালায়' এ প্রবাদটি ওতোপ্রেতো ভাবে মিশে গেছে। সেটি খুদেজারও বুঝার বাকি নেই। চারদিকের অস্থিরতা গ্রাস করেছে খুদেজা আর হাশেমকে।
ছয়
খুদেজার বাবা হাশেমকে ডেকে ভাল-মন্দ খুঁজ খবর নিলো, হাশেমকে আকারে ইঙ্গিতে ঋণের কথাও জিজ্ঞেস করলো। কিন্তু হাশেম মুখ খুলনা। খুদেজার বাবাও কথা বাড়াল না। শুধু এইটুকু বলল জানি তোমার চলা ফেরায় বর্তমানে একটু সমস্যা হচ্ছে তাই বলছিলাম যে, খুদেজাকে কিছুদিনের জন্য আমাদের এখানে রেখে যাও। তাতে তোমার ভালো হবে। তুমিও এসে থাকতে পারো। যাতে তোমার ভালো হয় সেভাবেই করো।
শ্বশুর বাড়ি থেকে বের হয়ে আরও একটু অস্থির হয়ে উঠলো। প্রত্যাশা অনুযায়ী কথা শুনতে পায়নি। তাই সে সিদ্ধান্ত নিলো সে চলে যাবে দুরে টাকা ইনকাম করেই সে বাড়ি ফিরবে।
সাত
খুদেজা রাতেই স্বামী হাশেমের অস্থিরতা টের পেয়েছিলো। কিন্তু হাশেম কিছুই বলেনি। মাঝে মধ্যে স্বামীকে জড়িয়ে ধরতে চেষ্টা করেছে, কিন্তু হাশেম এড়িয়ে গেছে। হাত-পা দূরে ছুড়ে মেরেছে। সারা রাত কারোই যে ভালো ঘুম হয়নি। হাশেম ঘুমাতে পারেনি কোথায়, কার কাছে গেলে একটি কাজের সন্ধান পাওয়া যাবে সেই প্লানিং নিয়ে। আর খুদেজার ঘুম হয়নি হাশেমকে নিয়ে সে কি ভাবছে, কি করতে চাইছে সেই ভাবনা নিয়ে।
খুদেজার জীবনে এই প্রথম দেখলও সকালে খুদেজা মুখ ধোয়ার আগেই হাশেম সাজগোছ করছে। হাশেম সিদ্ধান্ত নেয় সে সিলেটে চলে যাবে। তাদের গ্রামের দ'একজন লোক আছে ওখানে। বিয়ানী বাজারে কুলির কাজ করে ভালো রোজগার করছে। সে তাই সেখানেই চলে যাবে। কাউকে কিছু বলবে না। আর খুদেজাকে তো নয়ই।
খুদেজা হাশেমকে এই অবস্থায় দেখে একটি ধাক্কা খেল মনে। খুদেজা গিয়ে জড়িয়ে ধরলো হাশেমকে। জানতে চাইলো এতো সাজগোছ কেন? কোথায় যাওয়া হচ্ছে?
কোন কথার জবাব না দিয়ে, খুদেজার হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে বের হয়ে যাচ্ছিল হাশেম, খপ করে পায়ে জড়িয়ে ধরলো খুদেজা।
আচমকা হাশেম ধপকরে খুদেজার নাকে মুখেই লাথি মেরে বসলো। খুদেজা উপুড় হয়ে পরে গেলো। হাশেমও যেন ভেতরে একটি হোঁচট খেল, এমন একটি পরিস্থির জন্য প্রস্তুত ছিলোনা হাশেম নিজেও। তাছাড়া খুদেজাকে লাথি মারবে সে এমন নিষ্ঠুর ভাবে ভাবেনি কখনো। কিন্তু ঘটনা তো গঠে গেলো।
কোন ভাবনাই হাশেমকে থামাতে পারেনি, মনের উপর পাথর চাঁপা দিয়ে সিলেটের উদ্দেশ্যে এগিয়ে চললো।
আট
মেয়েটার জন্য মনটা ক্রমশ অস্থির হয়ে উঠছে খুদেজার মায়ের। রান্না-বান্না শেষ করে একবার যাবে ভেবেছিলো, কিন্তু নানান ঝামেলায় আর যাওয়া হয়নি। হঠাৎ উঠানের মাঝে দপ করে একটি আওয়াজ হলো। খুদেজার মা দ্রুত ঘর থেকে বের হলো। দেখে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলেন না তিনি। চিৎকার করলেন খুদেজার বাবা আরো অনেকে ছুটে এলেন। ছটফট করছে কিছুই বলছে না। হাতের মুঠোয় দেখতে পেলেন বিষের বোতল।
খুদেজার চোখ দিয়ে ঝর ঝর করে পড়ছে ফোঁটা ফোঁটা জল, কেউ ডাক্তার আনতে গেলো। অনেকে মুখ খোলার চেষ্টা করলো। ময়লা-আবর্জনা খাওয়াতে চেষ্টা করলো যাতে বমি করে। সকল চেষ্টাই বার্থ হলো কেউই খুদেজার মুখ খুলতে পারলো না। দাঁতের পাটিকে পেরেক ঢুকিয়েও না । হঠাৎ নিথর, নীরব নিঃস্পন্দন হয়ে পরে, খুলে যায় মুখ, তখন হা চেয়ে দেখে পাথর চোখে মানুষ ও ভালবাসা।